• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কথিত মানবাধিকার সংস্থার ‘চেয়ারম্যান’ চাকরির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ


FavIcon
নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২১, ০৮:৪১ পিএম
কথিত মানবাধিকার সংস্থার ‘চেয়ারম্যান’ চাকরির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ
কথিত মানবাধিকার সংস্থার ‘চেয়ারম্যান’ চাকরির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ

শাহীরুল ইসলাম সিকদার (৪৮)। এইচএসসি পাসের পর ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটি বাসের কন্ট্রাক্টর হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পরে ‘সিকিউরিটি গার্ড’ সরবরাহের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এভাবে চাকরির নামে হাতিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। পরে সেই অফিস বন্ধ করে শুরু করেন ফ্ল্যাট ও জমির ব্যবসা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা নিলেও ফ্ল্যাট কিংবা জমি বুঝিয়ে দেননি। কেউ টাকা ফেরত চাইলে দিতেন হুমকি। নিজেকে কখনো সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আবার মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিতেন। প্রতারণা করতে নামি দামি ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখতেন তিনি।

শুক্রবার রাত থেকে আজ (শনিবার) সকাল পর্যন্ত রাজধানীর রামপুরা বনশ্রী এলাকায় অভিযান চালিয়ে শাহীরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।শনিবার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
গ্রেফতারকালে তার কাছ থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, একটি শটগান, একটি এয়ারগান, একটি এয়ার রাইফেল, ২৩৭ রাউন্ড গুলি, পাঁচটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি খালি খোসা, ২২টি কার্তুজ, চারটি চাকু, তিনটি ডামি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেডের চাকরির আবেদন ফরম, চুক্তিপত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই, ব্যানার, প্যাড, স্ট্যাম্প, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, গোপন ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ড, নেমপ্লেট, বিভিন্ন নামি দামি ব্যক্তির সঙ্গে তোলা ছবি, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, পাসপোর্ট, মানি রিসিভ বই, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে র‌্যাব। র‌্যাব বলছে, রাজধানীতে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও জমিসহ দৃশ্যমান প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার কথিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসেস লিমিটেড, হোমল্যান্ড ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, মানবাধিকার সংস্থা, শাহীরুল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কো. লিমিটেড, হোমল্যান্ড হাউজিং, হোমল্যান্ড বেভারেজ অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মাদারল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড, শাহীরুল ইসলাম বাংলাদেশ আউট সোর্সিং অ্যান্ড পাওয়ার সাপ্লাইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন।সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, শাহীরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী আমাদের কাছে অভিযোগ দেন। তাদের অভিযোগের পর র‌্যাবের গোয়েন্দারা ছায়া-তদন্ত শুরু করে। পরে আমরা জানতে পারি শাহীরুল নিজেকে একটি কথিত মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান ও ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড’ নামক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। চাকরি দেওয়ার নামে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এমন অভিযোগে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় শাহীরুলের নিজের বাসা ও প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

যেভাবে উত্থান প্রতারক শাহিরুলের

উচ্চ মাধ্যমিক পাস শাহীরুল কর্মজীবন শুরু করেন গাড়ির ব্যবসা দিয়ে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সৌখিন পরিবহনে কাজ করেছেন তিনি। এরপর শুরু করেন প্রতারণা ব্যবসা। ২০০৩ সালে সিকিউরিটি গার্ড সরবরাহের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। অল্প সময়ে বিপুল টাকার লোভে ২০১৪ সালে রামপুরায় ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড’ নামের ওই প্রতিষ্ঠান খুলে শুরু করেন অর্থ আত্মসাৎ। এরপর থেকে তিনি অবৈধভাবে সম্পদের মালিক হতে শুরু করেন। প্রতারণার অভিযোগ আড়াল করতে শাহীরুল তার অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করেন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেডের পরিবর্তে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি বেনামি মানবাধিকার সংস্থা খুলে নিজেকে চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন।এছাড়া ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নামিদামি ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো প্রদর্শন করতেন এবং বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতেন। প্রতারণার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী-পুরুষকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড, ড্রাইভার, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, বিক্রয় কর্মকর্তা, লাইনম্যান হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

শাহীরুলের প্রতারণার কৌশল

শাহীরুল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিতে চাকরির চটকদার বিজ্ঞাপন দিতেন। দেশের শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আবেদন করলে তাদের কৌশলে তার পরিচালিত কোম্পানির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে প্রতিশ্রুতি দিতেন তিনি। এরপর চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ১৫-২৫ হাজার টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণ করতেন। তাছাড়া সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫-১০ লাখ টাকা নিতেন তিনি।
র‌্যাব জানিয়েছে, শাহীরুল নিজেকে শুটিং ক্লাবের সদস্য বলে পরিচয় দিতেন। প্রশিক্ষণ, ইউনিফরম ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবেও টাকা নেওয়া হতো। এভাবে অনেকের কাছ থেকে নামমাত্র নিয়োগ দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। তার অফিস বা বাসায় ঘোরাঘুরি করেও ভুক্তভোগীরা টাকা ফেরত পেতেন না। বরং টাকা চাইলে অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের ভয়ভীতি দেখাতেন তিনি। এছাড়া প্রতারক শাহীরুল নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে ডিএমপির রামপুরা থানায় চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মামলা রয়েছে।

কী পরিমাণ সম্পদ শাহীরুলের রয়েছে এমন প্রশ্নে মোজাম্মেল হক বলেন, ২০০৩ সাল থেকে তিনি প্রতারণায় জড়িত। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় দুটি বাড়ি, দুটি ফ্ল্যাট, দুটি গাড়ি ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তার নামে ২৪ কাঠা জমির তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার সম্পদ আমরা পেয়েছি। তবে ব্যাংক, ফিক্সড ডিপোজিট, স্বজনদের নামে কী পরিমাণ সম্পদ আছে তা এখনও জানা যায়নি।অস্ত্রগুলো কোথা থেকে কিনেছে বা সংগ্রহ করেছে জানতে চাইলে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, ‘উনি বলেছেন, সবগুলোর লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু কোনোটারই লাইসেন্স দেখাতে পারেননি তিনি।


Side banner
Link copied!