• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘অর্থমন্ত্রী রীতিমতো খেলাপি ঋণ বান্ধব’


FavIcon

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০১৯, ০২:৩৪ পিএম
‘অর্থমন্ত্রী রীতিমতো খেলাপি ঋণ বান্ধব’

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বিশ্বব্যাংক যে মন্তব্য করেছে তা ঠিকই আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টর সেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) প্রায় একই রকম কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, সার্বিক উন্নতির দিক থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ ভালো হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টর খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। উভয় সংস্থা একই রকম অভিমত দিয়েছে। আমরাও অনেক দিন ধরেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টর সম্পর্কে প্রায় একই রকম অভিমত দিয়ে আসছিলাম। আমাদের এই সমালোচনার উদ্দেশ্য দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে খাটো বা হেয় করা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ডুুবন্ত অবস্থা থেকে এই সেক্টরকে জাগানো। এখন বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিও একই কথা বলছেন। আমরা এখন অপেক্ষায় আছি, দেখি এতে সরকারের টনক নড়ে কি না।

দৈনিক জাগরণ : আপনি কয়েক দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকার এখন ঋণ খেলাপি বান্ধব। এই মন্তব্যের কারণ কি? এবং এই প্রেক্ষিতে ব্যাংকিং সেক্টরের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : খেলাপি ঋণের সমস্যা সব ব্যাংকের জন্যই অত্যন্ত জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আগে খেলাপি ঋণের সমস্যা মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রেই বেশি ছিল। এখন বেসরকারি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আগের যে অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের সমস্যার তেমন কোনো উন্নতি করতেই পারেন নি। তিনি ভালো ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করতে পারেন নি। কিন্তু তা সত্বেও তিনি ঋণ খেলাপি বান্ধব ছিলেন এটা বলা যাবে না। তিনি ঋণ খেলাপিদের বকাবকি করতেন ঠিকই কিন্তু তাদের টাচ করতে পারতেন না। কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী দেখা যাচ্ছে রীতিমতো খেলাপি ঋণ বান্ধব। আমার সাক্ষাৎকারে সরকার বলতে অর্থমন্ত্রীকেই বুঝাতে চেয়েছি। কারণ অর্থনীতি বা ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীই দায়বদ্ধ। কয়েক দিন আগে তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ঋণ খেলাপিরা তো ব্যবসায়ি। কাজেই তাদের জেলে যেতে হবে না। আমি বুঝতে পারিনা এটা কেমন কথা। কারণ পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশে ব্যবসায়িদের মধ্যে ২/৪ জন যারা খারাপ থাকেন বা যারা দুষ্ট প্রকৃতির তাদের জেলে যেতেই হয়। যারা ভালো তারা কেনো হয়রানির শিকার হবেন? যারা দুষ্ট প্রকৃতির তাদের তো শাস্তি পেতেই হবে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টর ১০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে এক লক্ষ কোটি টাকার কিছু কম হচ্ছে খেলাপি ঋণ। এছাড়াও প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। তাহলে এই ১ লক্ষ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বাদে অবশিষ্ট প্রায় পৌনে ৯ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যারা ব্যবসায় করছেন তারাই হচ্ছেন প্রকৃত ব্যবসায়ি। তারা তো ক্ষতিকর কিছু করছেন না। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেন আবার সময় মতো সুদসহ সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। তাদেরকে সৎ ব্যবসায়ি বলতে আমরা রাজি আছি। কিন্তু যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঠিক মতো পরিশোধ করেন না তারা কি সত্যিকার ব্যবসায়ি? কাজেই ঋণ খেলাপিদের ব্যবসায়ি আখ্যায়িত করে প্রোটেকশন দেয়া ঠিক হবে না। এটা করা হলে যারা সৎ ব্যবসায়ি এবং যাদের সংখ্যাই বেশি তারা হতাশ হবেন, তাদের অবমাননা করা হবে। শুধু তাই নয় এতে যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছিলেন তারাও খেলাপি হতে উৎসাহিত হবেন।

দৈনিক জাগরণ : সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আজ থেকে আর খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তারপরই ব্যাংকিং সেক্টর এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে যাতে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানো যাবে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমবে না। ব্যাপারটি কিভাবে দেখছেন?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই উদ্যাগটি নেয়া হয়েছে বলে মনে করি। কারণ তিনটি ঘটনা আমরা যদি একত্রিত করি তাহলে দেখবো, বর্তমান পর্যায়ে এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকারদের একটি সভায় একজন শীর্ষ ঋণ খেলাপি, যাকে খেলাপি বলা যাবে না মহামান্য আদালতের ‘স্টে অর্ডারের’ কারণে, তিনি বলেছিলেন, আপনারা খেলাপি খেলাপি করেন, আমরা এমন আইন করবো যাতে খেলাপি ঋণ বলে কিছু থাকবে না। এরপর থেকে আমরা লক্ষ্য করছি সমস্ত প্রচলিত নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে এমনভাবে আইনি সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে যাতে ঋণ খেলাপিরা সর্বোচ্চ সুবিধা পায়। যেমন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ঋণ গ্রহীতারা ঋণের কিস্তি পরিশোধে অধিকতর সময় পাবেন। ঋণ হিসাব অবলোপনের নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। আগে একটি ঋণ হিসাব মন্দ ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের পর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে অবলোপন করা যেতো। এখন তিন বছর পরই একটি ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে। মামলা দায়ের এবং শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের নীতিমালাও শিথিল করা হয়েছে। ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণের নিয়ম সহজীকরণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন সংস্কার কার্যক্রমে ১৫ বছরের জন্য একটি ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করা যাবে। পুন:তফসিলিকরণকৃত ঋণ হিসাবের সুদের হার হবে ৭ শতাংশ। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে আসবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের ফলে যে কাজটি হবে তাহলো আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। কারণ খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা তো বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি করে না। এটা ব্যাসেল এগ্রিমেন্টের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই প্রণয়ন করা হয়। আমরা এখন ব্যাসেল থ্রি’তে অবস্থান করছি। এটি সম্মানজনক ব্যবস্থা। আমার যদি সেই ব্যাসেল এগ্রিমেন্ট অমান্য করে খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করি তাহলে ব্যাংকের মূলধন ক্যালকুলেশনে সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রভিশন সংরক্ষণের বিষয়েও ঝামেলা হবে। মালিকরা যে প্রফিট পাবার কথা তার চেয়ে বেশি প্রফিট তারা নিয়ে যাবে। এগুলো সবই যে ব্যাংকিং সংস্কৃতির পরিপন্থি তাই নয় আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাাদশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। বিদেশের কোনো কোনো ব্যাংক আমাদের ব্যাংকের ঋণপত্র গ্রহণ করবে না। সেই অবস্থায় আমাদের ব্যাংকের ঋণপত্র গ্রহণ করার জন্য অন্য একটি ব্যাংকের নিশ্চয়তা পত্র দিতে হবে। এতে পণ্য আমদানি ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যাবে,যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

দৈনিক জাগরণ : আপনার দীর্ঘ ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংকিং সেক্টরের এমন কিছু সমস্যার কথা বলবেন কি যা তেমনভাবে আলোচিত হয় নি। কিন্তু আলোচনার দাবি রাখে?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাংক-কাস্টমার রিলেশনশিপ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। অথচ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থমন্ত্রী মহোদয় যেসব বিধিমালা করতে যাচ্ছেন তাতে আগামীতে ব্যাংক-কাস্টমার রিলেশনশিপ ভেঙ্গে যেতে পারে। আমাদের এই প্রসঙ্গে পুরনো কথা মনে করতেই হয়। ইংল্যান্ডে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয় তখন কোনো ব্যাংকিং আইন ছিল না। ব্যাংকার এবং গ্রাহকের পরস্পর আস্থার উপর নির্ভর করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এরপরে ব্রেঞ্চে বসে ব্যাংকিং করতো। সেই অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজকের অবস্থায় এসেছে। ইংল্যান্ডেই প্রথম ব্যাংকিং আইন প্রণীত হয়। ব্যাংক পরিচালনার জন্য আইন করা হচ্ছে এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ব্যাংকিং ব্যবসায় চলছে ব্যাংক-গ্রাহক আস্থার উপর নির্ভর করে। কোনো কারণে যদি এই পারস্পিরিক আস্থা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য। কোনো ব্যাংকের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গেলে সেই ব্যাংক থেকে গ্রাহক চলে যায়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংক। ফারমার্স ব্যাংকের উপর থেকে সাধারণ গ্রাহকের আস্থা চলে যাবার পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে এই ব্যাংকের সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থায়ন করতে বলা হলো। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হলো না। শেষ পর্যন্ত এই ব্যাংকের নামই পরিবর্তন করা হলো। বিষয়টি এই রকম যে, আগের নামই রাখবো না দেখি তাতে জনগণের আস্থা ফেরে কিনা। এটি একটি উদ্ভট কল্পনা মাত্র। ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থা দেখে এটা অনুধাবন করা যায় আসলে আইন কখনোই মানুষের আস্থার বিকল্প হতে পারে না। বলা হচ্ছে, সরকার কর্তৃক নিয়োজিত চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে যাচাই করে দেখা হবে কোন খেলাপি ভালো আর কোন খেলাপি মন্দ। প্রত্যেকটি ব্যাংক তো একাধিক চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে তাদের ব্যালেন্সশিট নিরীক্ষা করে থাকে। তাহলে নতুন করে আবার কেনো চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে যাচাই করেত হবে কেনো? এতে সরকারের আস্থাভাজন ঋণ খেলাপিরা বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন। আবার যারা সরকারের আস্থাভাজন নন তারা খারাপ হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারেন। একটি ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক দিয়ে অডিট করানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিম অডিট করে। আবার বাণিজ্যিক নিরীক্ষা দল কর্তৃক নিরীক্ষা করানো হয়। এই অবস্থায় পুনরায় চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে অডিট করানোর কোনো প্রয়োজন আছে কি?

দৈনিক জাগরণ : আপনি আগেও একবার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা আমাদের জানাই আছে। কাজেই নতুন করে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে সমস্যা জানার দরকার নেই। এখন দরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার। বর্তমানে আবারো নতুন করে সমস্যা জানার দরকার আছে কি?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : আমি তো তা মনে করি না। সমস্যা আমাদের জানাই আছে। ব্যাংকের সমস্যা ব্যাংকার জানে, কাস্টমার জানে এমন কি সরকারও ভালোভাবেই অবহিত আছে। কাজেই ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা নতুন করে জানার প্রয়োজন নেই। এখন প্রয়োজন শুধু সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত। যে কারণে আবারো নতুন করে সমস্যা খুঁজে বের করার কথা বলা হচ্ছে। এটা আর কিছুই নয় সময় ক্ষেপনের একটি কৌশল মাত্র।

দৈনিক জাগরণ : কিছু দিন আগে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে একই পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে একই সঙ্গে ৪ জন পরিচালক নিয়োগ এবং তাদের মেয়াদকাল অব্যাহতভাবে ৬ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর করা হয়েছে। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?


Side banner
Link copied!