
‘গত বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রিমালে পুরো ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে পুরো ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ঘরভিটাটিও পানির স্রোতে ধুয়ে গেছে। ঘরে থাকা আসবাবপত্রও সরাতে পারি নাই।পরে ধারদেনা করে অন্যের জমিতে কোনো মতে একটি ছোট ঘর করে সেখানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতেছি। সেই ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই আবারও ঘূর্ণিঝড় আসার খবর শুনে আতঙ্কে দিন কাটছে। না জানি আবারও ঘূর্ণিঝড় এসে ঘরবাড়ি নিয়ে যায়।’ চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সাগর মোহনার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন ঢালচরের পঞ্চাশোর্ধ নারী হোসেনেয়ার বেগম।হোসেনেয়ার জানান, স্বামী নাছির মিয়া জেলের কাজ করতেন। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের সংসার। সাগর মোহনায় বসবাস করায় প্রায়ই সময়ই নদী ভাঙন ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করেই তাদের বাঁচতে হয়। গত বছর ঘূর্ণিঝড়ের সময় তাদের ঘরটি উড়িয়ে নিয়ে যায়।ঘরের কোনো মালামাল সরানোর সময় পাননি। বর্তমানে ঘরের জায়গাটিও নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে অন্যের জমিতে পুরনো টিন দিয়ে ছোট একটি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। এর পর থেকেই ঝড়ের কথা শুনলে মনের মধ্যে অজানা ভয় কাজ করে। না জানি আবারও ঝড়ে মাথা গোজার একমাত্র ঘরটি উড়িয়ে নিয়ে যায়।ঝড়ে ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাননি। নিজেদের খরচে আবারও ঘর তুলতে হয়েছে।
ঢালচর ইউনিয়নে তার মতো এরকম পাঁচ শতাধিক পরিবারে দুই থেকে তিন হাজার লোকের বসবাস। তাদেরকে ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচতে হয়। এর আগে এই ইউনিয়নটিতে ১০ থেকে ১২ হাজার লোকের বসবাস ছিল। নদী ভাঙন ও ঝড়ের কবলে পরে অনেকে চরফ্যাশন উপজেলার মূল ভূখণ্ডে চলে এসেছে। ইউনিয়নটিতে কোনো আশ্রয় কেন্দ্র নেই। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনতলা একটিমাত্র পুলিশ ফাঁড়িই সেখানকার বাসিন্দাদের ভরসা।
এ ছাড়াও ভোলার বিচ্ছিন্ন প্রায় অর্ধশতাধিক চরে কয়েক লাখ লোকের বসবাস। ঘূর্ণিঝড়ের সময় এ সব চরাঞ্চলের মানুষ আতঙ্কে থাকেন।
একই উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর কুকরি-মুকির ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সুমন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় এলেই সেখানকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ ইউনিয়নটি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় লোকজনের যাওয়ার কোনো পথ নেই। সেখানে নেই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। এ ছাড়াও বাড়ি-ঘর ও গবাদি পশু রেখে কেউ দূরে যেতে চান না। তাই ঘূর্ণিঝড়ে জীবনের চেয়ে ঘর-বাড়ি ও মালামাল হারানোর ভয় বেশি কাজ করে চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে।’
চলতি মে মাসে আসন্ন শক্তি ও মন্থা নামের দুইটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার খবরে একইভাবে আতঙ্ক বিরাজ করছে চরফ্যাশন উপজেলার চর নিজাম, চর পাতিলা, মুজিবনগরের চর সিকদার, লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের চর শাহজালাল ও চর কচুয়া, মনপুরা উপজেলার চর কলাতলি, তজুমদ্দিন উপজেলার চর জহিরুদ্দিন, চর মোজাম্মেল, বাসনভাঙার চর, দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর, মদনপুর, নেয়ামতপুর, এবং ভোলা সদর উপজেলার মাঝের চর, রামদাসপুর, চরচটকিমার, চর হোসেন, গাজীর চরসহ অর্ধশতাধিক বাসিন্দাদের মধ্যে।
ভোলা আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মো. মাহবুবুর রহমান জানান, মে মাসের ২৩ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ ও ২৯ তারিখ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে শক্তি এবং মন্থা নামের দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ের কোনো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। এমনিতেই মাঝে মধ্যে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ভোলায় দুই দশমিক সাত মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান বলেন, ‘ভোলায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো বাঁধ নেই। তবে যেগুলো দুর্বল আছে সেগুলো মেরামতের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই সেগুলো মেরামত কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, ‘ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য ৮৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্র ও ১৪টি কিল্লা রয়েছে। আসন্ন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি হিসেবে আগামী শনিবার সব সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করা হবে। পর্যাপ্ত খাবার ও ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। এ ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের মানুষকে নিরাপদে রাখতে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :