• ঢাকা
  • রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ট্রাম্পের বিবৃতিতে কতটা বিপাকে পড়েছে ভারত?


FavIcon
অনলাইন ডেস্ক:
প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২৫, ১১:১৩ এএম
ট্রাম্পের বিবৃতিতে কতটা বিপাকে পড়েছে ভারত?

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করার পর থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিনই ভারত নিয়ে মুখ খুলছেন। তিনি নিয়মিত ভারত ও পাকিস্তান নিয়ে, ভারতের বাণিজ্য শুল্ক কম করা নিয়ে, অ্যাপলকে ভারতে আইফোন না বানানোর পরামর্শ দিয়ে যা বলছেন, তাতে কি নরেন্দ্র মোদি সরকার বিপাকে পড়ছে? প্রতিদিনই বিরোধীরা ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে সরকারকে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

ট্রাম্প যা বলেছেন

ভারত ও পাকিস্তান যে সংঘাত থামিয়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে, সেই ঘোষণাটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বা দুই দেশের প্রতিরক্ষা বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা সেনার তরফ থেকে আসেনি। নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোস্যালে এই ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।তারপর থেকে নিয়মিত এই যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব ট্রাম্প নিজেকে দিচ্ছেন এবং একাধিক মন্তব্য করেছেন।

 

ট্রাম্প প্রথমে বলেছিলেন, ‘আমেরিকার মধ্যস্থতায় হওয়া এক রাতের আলোচনার পর আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভারত ও পাকিস্তান অবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বাস্তববোধ ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েছে বলে দুই দেশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ ট্রাম্পের এই বার্তার পর ভারত, পাকিস্তান এবং গোটা বিশ্ব জানতে পারে, যুদ্ধবিরতি হয়েছে।তার পরের দিনই যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের প্রশংসা করে তিনি  বলেন, ‘আমি খুবই গর্বিত যে যুক্তরাষ্ট্র এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পেরেছে। আমি দুই দেশের সঙ্গেই কাজ করব। দেখতে চাই, হাজার বছর পরে কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান হয় কি না।’

 

কাশ্মীর সমস্যা হাজার বছর ধরে চলছে, এমন তথ্য ট্রাম্প কোথা থেকে পেয়েছেন, তা জানাননি।তবে এরপর ট্রাম্প জানান, বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়ে তিনি দুই দেশকে সংঘাত থামাতে বাধ্য করেন। এরপরেও ট্রাম্প থামেননি। তিনি বলেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা ভয়াবহ হচ্ছিল। রোজ নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দেখা যাচ্ছিল। আমরা তা মিটিয়েছি।আমরা বলছি, এস বাণিজ্য করা যাক।’

 

তারপর বৃহস্পতিবার ট্রাম্প দাবি করেছেন, প্রায় সব পণ্যে শুল্ক কমাতে ভারত রাজি হয়েছে। তারপর তিনি বলেছেন, অ্যাপল ভারতে যে আইফোন তৈরির কারখানা করছে, সে ব্যাপারে তার আপত্তি আছে। ভারত চড়া হারে শুল্ক বসায়। ফলে ব্যবসা করতে অসুবিধা হবে। 

কংগ্রেস ও বিরোধীদের দাবি

লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে দাবি করেছেন, সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হোক। সেখানে পহেলগাম, অপারেশন সিঁদুর এবং যুদ্ধবিরতি যা প্রথমে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তা নিয়ে আলোচনা হবে, সব বিরোধী দল এটাই চাইছে। সব বিরোধী দল পেহেলগামের পর সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল, অপারেশন সিঁদুর সমর্থন করেছিল। যুদ্ধবিরতির পর তারা এবার প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।

রাজ্যসভার নেতা এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও একই দাবি করেছেন। গত ১৪ মে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত যে প্রত্যাঘাত করছিল, তা হঠাৎ থামিয়ে দেয়ায় আমরা বিস্মিত। এটা স্পষ্ট হচ্ছে না, ফলে গুজব ছড়াচ্ছে। ট্রাম্প সবচেয়ে আগে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তিনিই দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন করেছেন। তিনি বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়ে ভারতকে চাপ দিয়েছিলেন। ভারত সরকার পুরো চুপ করে আছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। অতীতে ভারতের সব সরকার দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে, কাশ্মীর হলো ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। তৃতীয় কোনো দেশের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। ট্রাম্পের দাবি ভারত খণ্ডন করেনি। আমরা মনে করি, আমাদের জাতীয় অবস্থান ও সম্মানের সঙ্গে সমঝোতা করা হয়েছে।’

কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, ‘ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল শুল্ক-বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে ওয়াশিংটন গেছেন। ট্রাম্প দোহা থেকে দাবি করছেন, সরকার চুপ করে আছে।’

লালু প্রসাদ যাদবের আরজেডি, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা কংগ্রেসের দাবি সমর্থন করেছে। তেজস্বী যাদব বলেছেন, ‘সংসদ থেকে একটা স্পষ্ট বার্তা যাওয়া দরকার। বাণিজ্যের নামে আমরা কখনো ঝুঁকব না। আমরা সার্বভৌম দেশ। আমাদের তৃতীয় কোনো দেশের হস্তক্ষেপের দরকার নেই।

উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনার নেতা সঞ্জয় রাউত বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে, আমরা কোন প্রতিশোধ নিয়েছি? কেন কোনো তৃতীয় পক্ষ সংঘাত থামাবে, কেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ থামাতে পারেন না? আমাদের দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্য কোনো দেশের নেই।’

বিজেপির তিরঙ্গা যাত্রা

বিজেপি দেশজুড়ে তিরঙ্গা যাত্রা শুরু করেছে। অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য দাবি করে এই যাত্রা হচ্ছে। এই বছরই বিহারে বিধানসভা ভোট। ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুতে, ২০২৭ সালে উত্তরপ্রদেশে, ২০২৮ সালে কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফলে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই সামনে আছে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিজেপি অপারেশন সিঁদুরের বিজয়োৎসব পালন করছে। 

এর মধ্যে বিজেপি সাংসদ অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত সামাজিক মাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘ট্রাম্প হলেন আলফা মেল, মোদি হলেন আলফা মেল কা বাপ।’ পরে এই পোস্ট ডিলিট করে তিনি বলেছেন, বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা তাকে পোস্টটি ডিলিট করতে বলেছেন। তিনি ব্যক্তিগত মতামত এভাবে পোস্ট করায় দুঃখিত। পোস্টটি ডিলিট করে দেয়া হলো।

কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেছেন, ‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে কথা চলছে। এটা জটিল আলোচনা। কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দুই পক্ষের লাভ হয় এমন বাণিজ্যচুক্তি করা হবে।’

বিপাকে ফেলে দিয়েছেন ট্রাম্প?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ট্রাম্প এই মন্তব্য করে ভারতকে ধরাশায়ী করে দিয়েছেন। ভারত আঞ্চলিক প্লেয়ার থেকে আন্তর্জাতিক প্লেয়ার হতে চাইছিল, জি২০তে গুরুত্ব পাচ্ছিল, বিশ্বগুরু নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেই ভারতকে বিশাল ধাক্কা দিয়েছেন ট্রাম্প।’

প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছিলেন, ১৯৭১-এ যুদ্ধ বন্ধ করতে, ইন্দিরা শোনেননি। আমেরিকা সেভেন ফ্লিট পাঠায়, তাও ইন্দিরা পিছু হটেননি আর এবার বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের হুমকিতেই যুদ্ধবিরতি হয়ে গেলো!’

বিশ্বনাথ বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভূরাজনৈতিক কারণে ভারতকে প্রধান পার্টনার করেছিল। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে কোয়াড তৈরি হয়। ট্রাম্প পুরো বদলে দিলেন। তিনি পুরনো বন্ধু হিসেবে পাকিস্তানকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। ক্লিন্টনের সময় থেকে ভারত যে প্রাধান্য পাচ্ছিল, সেখান থেকে সরে এলেন ট্রাম্প। আজ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যদি অ্যাপলকে ভারতে বিনিয়োগ করতে মানা করেন, তারপরে তারা কি তাকে অমান্য করে এই বিনিয়োগ করতে পারে?’

শরদের মতে, ‘প্রতিবার যুদ্ধের পর ভারতে একটা ইউফোরিয়া থাকে কিন্তু এবার নেই। এমনকি কার্গিলের পরও তা ভরপুর ছিল। পোখরান ২-এর পর ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল কিন্তু ভারত তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি। এবার কী হলো, যার জন্য ট্রাম্পের বাণিজ্য হুমকি মেনে নিতে হলো?’

যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন, ‘প্রশ্ন হলো, ভারত ও পাকিস্তান কি যুদ্ধবিরতি করেছে, নাকি আমেরিকা করিয়েছে? যদি ভারত ও পাকিস্তান এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সবচেয়ে আগে ট্রাম্প কী করে ঘোষণা করেন? যদি দুই দেশ সিদ্ধান্ত নেয়....তাহলে তৃতীয় পক্ষ কী করছিল? কী করে ট্রাম্প দাবি করেন, আমেরিকা হস্তক্ষেপ করে সংঘাত থামিয়েছে। তাহলে তো মানুষের জানার অধিকার আছে, কে যুদ্ধ বন্ধ করালো? ভারতের এতদিনের অবস্থান তো ছিল, তৃতীয় কোনো পক্ষকে তারা কাশ্মীরের বিষয়ে ঢুকতে দেবে না। তাহলে কি অবস্থান বদলেছে।’

যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন, ‘আমেরিকা বলছে, এরপর তৃতীয় কোনো নিরপেক্ষ দেশে ভারত ও পাকিস্তান আলোচনায় বসবে এবং কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করবে। অথচ, প্রধানমন্ত্রী কিছু বলছেন না। ট্রাম্প বলেছেন, এই সমঝোতা বাণিজ্যের শর্তে হয়েছে।  ট্রাম্প যা বলছেন, তা কি সত্যি, এটা তো সরকারকে বলতে হবে?


Side banner
Link copied!