সুনামগঞ্জের ছাতকে মাত্র এক বছরের মেয়াদে প্রশাসনিক দক্ষতা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সাহসিকতা ও মানবিকতার স্বতন্ত্র দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলামকে বদলি করা হয়েছে। সোমবার (৮ ডিসেম্বর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে তাঁকে বর্তমান দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এর আগে ১ ডিসেম্বরের আরেক প্রজ্ঞাপনে ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মিজ ডিপ্লোমেসি চাকমাকে ছাতকের নতুন ইউএনও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। হঠাৎ এ বদলিতে ছাতকজুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিরাজ করছে গভীর আক্ষেপ ও আবেগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়ায় উঠে এসেছে যে, তিনি শুধু একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নন, তিনি ছিলেন ছাতকের মানুষের প্রকৃত সেবক, আস্থা ও ভরসার অবিচল প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছেন, সদিচ্ছা ও নিষ্ঠা থাকলে অল্প সময়ও জনকল্যাণে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তার কঠোরতা ও মানবিকতার সমন্বয়ে তিনি এলাকায় শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন। তাই ছাতকের মানুষ তাঁকে আজীবন স্মরণ করবে একজন দৃঢ়চেতা, আদর্শবান ও জনবান্ধব প্রশাসক হিসেব। স্বল্প সময়েই মানুষের আস্থা অর্জন করা এই কর্মকর্তার বদলি ছাতকের জনগণের হৃদয়ে স্পষ্ট শূন্যতা তৈরি করেছে।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে ছাতকে যোগ দিয়ে স্বল্প সময়েই নিজেকে জনগণের আস্থা, ভরসা ও নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত করেছিলেন তরিকুল ইসলাম। ইউএনওর মূল দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন উপজেলা প্রশাসক, পৌর প্রশাসক, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব। তাঁর কঠোর, স্বচ্ছ ও গতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ছাতকের রাজস্ব আদায় প্রায় দ্বিগুণ হয়। দালালমুক্ত প্রশাসন, দুর্নীতি দমন, অফিস-দপ্তরে শৃঙ্খলা ফেরানো ও সেবা সহজীকরণের মাধ্যমে তিনি জনভোগান্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনেন। পিআইসি, কাবিটা, কাবিখা, টিআর, এডিপিসহ সকল বরাদ্দের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে তিনি শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেন। তরিকুল ইসলামের সবচেয়ে প্রশংসিত উদ্যোগ ছিল গোবিন্দগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্টে দীর্ঘ ৫৪ বছরের বঞ্চনা ঘোচাতে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন মাছবাজার নির্মাণ। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ময়লা-আবর্জনায় ভরা প্রায় ৫ ফুট গভীর জায়গাটিকে তিনি একটি সুসংগঠিত বাজারে রূপান্তর করেন, যা উদ্বোধনের পর থেকেই শতাধিক মৎস্যজীবী পরিবারের জীবিকা ও আর্থিক নিরাপত্তার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। এই বাজারের দোকানকোটা সরকারি একসনা বন্দোবস্তের মাধ্যমে জলাইযুদ্ধা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এবং গরিব মৎস্যজীবীদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত জনমনে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। উন্নয়নভিত্তিক আরও উদ্যোগের মধ্যে ছিল পরিত্যক্ত মারওয়া টিলাকে পর্যটন স্পটে রূপান্তরের উদ্যোগ, পৌরসভার পুরাতন ভবনকে আধুনিক লাইব্রেরিতে রূপান্তর, ১৭ বছর বন্ধ থাকা হাইস্কুল মাঠ সংস্কার করে খেলার উপযোগী করা, পৌরসভার অধীনস্ত বিভিন্ন পুকুর সংস্কার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী কল্যাণ সমিতির কার্যালয় উদ্বোধন এবং হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ তদারকি। ভূমি খেকো, নদী দখলকারী ও মাদককারবারিদের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থান তাঁকে অপরাধীদের আতঙ্কে পরিণত করেছিল। ছদ্মবেশে খেয়াঘাটসহ প্রায় ২৫০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, মাদক মামলায় দণ্ড প্রদান, অবৈধ বালু-পাথর জব্দ ও জরিমানা সব মিলিয়ে তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এক দৃঢ় অবস্থান নেন। বাজার মনিটরিং, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষক-ভোক্তা স্বার্থে নেয়া তাৎক্ষণিক পদক্ষেপগুলো ছিল অত্যন্ত কার্যকর। শিক্ষা উন্নয়নে তাঁর অবদানও ছিল যুগান্তকারী। ছাতক পৌরসভার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০২৪ সালে মেধাবৃত্তি পরীক্ষা চালু করেন তিনি, এবং এর ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালেও সফলভাবে দ্বিতীয় মেধা পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। মানবিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক পুশইন হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের তাৎক্ষণিকভাবে আশ্রয়, খাদ্য, পোশাক, ওষুধ ও নগদ অর্থ সহায়তা দেন। সাত সন্তানের জননী আফিয়া বেগমের দুঃসময়ের খবর পেয়ে রাতেই খাদ্যসামগ্রী, টিন ও নগদ অর্থ পৌঁছে দেন।
তাছাড়াও পৌর প্রশাসক হিসেবেও তিনি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। রাজস্ব খাতভুক্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং কর্মশালা, পৌরসেবায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং নগর উন্নয়ন কার্যক্রমের ত্বরান্বিতকরণ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। অপরাধী ও সিন্ডিকেটচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জেরে যখন তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়ানো হয়, তখন সাধারণ মানুষ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে তাঁর সততার পক্ষেই সাক্ষ্য দেন। গোবিন্দগঞ্জ বাজারের সরকারি ভূমি বন্দোবস্ত নিয়ে অভিযোগও প্রশাসনিক তদন্তে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
আপনার মতামত লিখুন :