
সরকারি খাস জমি নিয়ে জাল- জালিয়াতি, প্রতারণা, আইন ও নীতি বিরোধী কাজের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে মতলব পৌর ভূমি অফিস। বন্দোবস্ত বহির্ভূত ও অন্যান্য ভূমিসহ খাস জমি ভুয়া ও জাল কবুলিয়ত দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়ার গুরুত্বর অভিযোগ পাওয়া গেছে। মতলব পৌর ভূমি অফিসের দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তাগণ খাস জমি বন্দোবস্ত দিতে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠিছিলেন যে, শিশু বয়সের মানুষের নামেও কবুলিয়ত দলিল সম্পাদন করে দেন! মতলব পৌর ভূমি অফিসের নথি জালিয়াতির ঘটনার অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন করতে গিয়ে বের হয়ে আসে এমন অবাক করা তথ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রত্যেক মৌজার ১নং খতিয়ানভুক্ত সম্পূর্ণ জমি খাস জমি হিসেবে সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত থাকে। এই খাস জমির মধ্যে বন্দোবস্ত বহির্ভূত হিসেবে রাস্তাঘাট, নদ-নদী, খাল, বিল, কবরস্থান, শ্মশান, পার্ক, খেলার মাঠ, বাঁধ, হালট, গোপাট ইত্যাদি শ্রেণি ভুক্ত জমি রয়েছে। তেমনি ভাবে নাল,বোর, বাড়ী, ভিটি ইত্যাদি শ্রেণিভুক্ত বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে এমন জমিও থাকে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানের সকল নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে মতলব পৌর ভূমি অফিসের দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ প্রতারণার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের সীল ও স্বাক্ষর জাল করে জমির দালাল সিন্ডিকেটের সহায়তায় কতিপয় ব্যক্তির নামে ভুয়া কবুলিয়ত দলিল সৃষ্টি করেন। আর এইসব কবুলিয়ত দলিল গ্রহিতাগণ তাদের নামে জমির খাজনা প্রদানের রশিদ এবং ভুয়া কবুলিয়ত দলিল দিয়ে প্রকৃত তথ্য গোপন করে রেকর্ড পাওয়ার জন্য বিজ্ঞ আদালতে মামলা করেন এবং করছেন। আদালতে করা মামলার রায় নিজেদের পক্ষে আনার জন্য দেওয়ানি আদালতে রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী গভর্নমেন্ট প্লিডার (জিপি) এর উদাসিনতা বা পৌর ভূমি অফিসের তহসিলদ্দারের মিথ্যা তথ্য প্রদান ও স্বাক্ষীর কারণে ওই সকল ভূমি বেহাত হয়েছে এবং হতে যাচ্ছে! এছাড়াও আদালতের কোনো রায় ডিক্রি ছাড়াই সরকারি খাস জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে নতুন খতিয়ান সৃষ্টি করে ভলিয়মে যুক্ত করা হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, নিয়ম অনুসারে সরকারি খাস জমি যে সকল ব্যক্তি কবুলিয়ত দলিল প্রাপ্ত হবেন তাদের প্রথমে উক্ত জমির মূল্য পরিশোধ করতঃ জেলা প্রশাসক কবুলিয়ত দলিল সম্পাদন করেন এবং সার্ভেয়ার স্কেচ নকশার মাধ্যমে বন্দোবস্তকৃত ভূমি চিহ্নিত করেন। কবুলিয়ত দলিলটি সাব-রেজিস্টার অফিসের মাধ্যমে রেজিষ্টিকৃত হয় এবং নিয়ম অনুসারে প্রতিবছর খাজনা প্রদান করতে হবে।
কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে সকল ব্যক্তি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে খাস জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন তাদের নামে থাকা মতলব পৌর ভূমি অফিসের খাজনা আদায়ের তলববাকি বইয়ে বন্দোবস্ত পাওয়ার তারিখ এবং খাজনা প্রদানের তারিখের মধ্যে অনেক গড়মিল পাওয়া যায়। সেই সাথে খাজনা আদায়ের তলববাকি বইয়ে অতিরিক্ত পৃষ্ঠা যুক্ত করা হয়েছে। সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জাল-জালিয়াতি হয়েছে মতলব পৌর ভূমি অফিসের আওতাধীন বাইশপুর মৌজায়। এছাড়াও কলাদী, দিঘলদী, চর পাথালিয়া, নিলক্ষী, চরমুকুন্দি, আলগীমুকুন্দি ও দক্ষিণ উদ্দমদীসহ কয়েকটি মৌজায় সরকারি খাস জমি ভুয়া বন্দোবস্ত দলিল ও খতিয়ান সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে দেওয়া হয়েছে। বন্দোবস্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে ১নং খতিয়ানে থাকা নদী ও খাল শ্রেণিভুক্ত ভূমির (যাহা বন্দোবস্ত বহির্ভুত) শ্রেণি পরিবর্তন করে নাল করা হয়েছে এবং মৌজার সরকারি খাস ১ নং খতিয়ানের সঠিক তথ্য পরিবর্তন করে নতুন করে কাগজ যুক্ত করা হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, মতলব পৌরসভার সদরের কলাদী মৌজায় যে সকল ব্যক্তি ভুয়া বন্দোবস্ত দলিলের মাধ্যমে খাস জমি নিয়েছেন তাদের বন্দোবস্ত নথি ও খাজনা প্রদানের তারিখের সাথে ব্যাপক অমিল রয়েছে। সেই সাথে কবুলিয়ত দলিলে যে রেজিস্টেশন নম্বর দেওয়া হয়েছে তার কোনো অস্তিত নেই। এছাড়াও জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর ও সীল নকল করা হয়েছে। কলাদী মৌজায় বন্দোবস্ত নথি নং ২৭/৭৯-৮০ মূলে খালের ভূমিকে ভিটি হিসেবে দেখিয়ে ২ শতাংশ বরাদ্দ নিয়েছেন একজন সাবেক জনপ্রতিনিধি! মজার বিষয় হলো ৭৯-৮০ অর্থ বছরে বন্দোবস্ত নেওয়া হলেও তিনি খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। এরুপ ভাবে বন্দোবস্ত নথি নং ০৪/৭০-৭১ মূলে দেড় শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বন্দোবস্ত নথি নং ৩৬/৮১-৮২ মূলে দুই শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৮ সালে, বন্দোবস্ত নথি নং ২৮৯০/৯৭-৯৮ মূলে পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৮ সালের জুন মাসে।
অপরদিকে আলগীমুকুন্দি মৌজায় প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের জন্য জমি ক্রয় এবং অধিগ্রহণ করা হবে এমন খবরে সক্রিয় হয়ে ওঠা ভূমি দস্যুরা নজর দেন খাস জমির দিকে। এই মৌজার ১নং খতিয়ানের বন্দোবস্ত বহির্ভুত ৭ একর ১৩ শতাংশ ভূমির মধ্যে শ্রেণি হিসেবে খালের ভূমিকে নাল হিসেবে পরিবর্তন করে ২ একর ৭৫ শতাংশ ভূমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এতে বন্দোবস্ত নথি নং ১০৪/৮০-৮১ মূলে চার শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৬ সালে, বন্দোবস্ত নথি নং ২২২/৯৯-২০০০ মূলে সাড়ে তিন শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৭ সালে, বন্দোবস্ত নথি নং ২২/৯৯-২০০০ মূলে সাড়ে তিন শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৮ সালে, বন্দোবস্ত নথি নং ২৩৪,২৫৭, ২৬৪, ২৩৮,২৫৮/৯৯-২০০০, মূলে ১ একর ৫০ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে আদায় হয়েছে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে। এছাড়াও বন্দোবস্ত নথি নং ২০/৯৬-৯৭ ও ৩৫/৮১-৮২ মূলে সাড়ে ৩২ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে খাজনা আদায় হয়েছে ২০১৭ সালে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলগীমুকুন্দি মৌজায় ভুয়া কবুলিয়ত দলিলের গ্রহীতাগণের মাঝে বিশ্বাস অর্জনে পৌর ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ মৌজার খতিয়ানের ভলিয়মে আদালতের রায় ডিগ্রি ছাড়াই অতিরিক্ত চারটি খতিয়ান (১১৫ নং থেকে ১১৮ নং পর্যন্ত) যুক্ত করা হয়। এতে মৌজায় ১নং খতিয়ানে সাবেক ৭৬ হালে ১৩৪, সাবেক ৮২ হালে ২০৮ দাগের ভূমির শ্রেণি খাল হিসেবে থাকলেও নতুন করে সৃষ্টি করা খতিয়ানে নাল হিসেবে দেখানো হয়েছে। এতে শিলমদী গ্রামের অলি উল্ল্যাহ প্রধানের ছেলে রিয়াছাত উল্ল্যাহ (যিনি সার্ভেয়ার রিয়াছাত উল্ল্যাহ নামে পরিচিত) ১১৫ নং খতিয়ানে ১৩৪ দাগে ২৫ শতাংশ, ১১৬ নং খতিয়ানে মতলব পৌরসভার সাবেক মেয়র আওলাদ হোসেন লিটন ৩৫ শতাংশ, ১১৭ নং খতিয়ানে চরমুকুন্দি গ্রামের ছিডু প্রধানের ছেলে খলিলুর রহমান ও তার স্ত্রীর নামে ২৯ শতাংশ এবং ১১৮ নং খতিয়ানে ঢাকিরগাঁও গ্রামের হারুন রশিদের পুত্র ও স্ত্রীর নামে ৪৯ শতাংশ ভুয়া রেকর্ড দেখিয়ে নথি সৃষ্টি করা হয়।.......বাকি অংশ আগামী পর্বে।
আপনার মতামত লিখুন :